শেখ হেদায়েতুল্লাহ, খুলনা:মাদক ব্যবসায়ী, মাদকসেবী ও মাদক বহনকারীদের দমন করতে দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান শুরু গত ১৮ মে থেকে। অভিযান চলাকালে দেড় শতাধিক মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন।
এই অভিযানের মধ্যেও মাদক কেনাবেচা, মাদক বিক্রেতাদের তৎপরতা কিছুটা কৌশলীভাবে চলতে থাকে। তবে একে বারেই থেমে থাকেনি।
অভিযান কিছুটা শিথীল হওয়ার সাথে সাথে বর্তমানে তাদের আনাগোনাও বেড়েছে। মে মাসের ১৮ তারিখ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান শুরু হবার পর গত ১৯ জুন পর্যন্ত খুলনা জেলা পুলিশের তালিকাভুক্ত মাদক বিক্রেতার মধ্যে মাত্র ১৯জন গ্রেফতার হয়েছে। অন্যরা রয়েছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। যদিও জেলা পুলিশের তালিকায় মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে মাত্র ১০৯ জন। কিন্তু মাদক বিক্রেতা রয়েছে এই তালিকার কমপক্ষে এর দশগুণ। বিশেষ অভিযানের এক মাস পরও উল্লেখযোগ্য সফলতা দেখা যায়নি।
পুলিশ ও র্যাবের এমন প্রাণঘাতী অভিযানের পরও থেমে নেই মাদক সরবরাহ ও কেনাবেচা। খুলনা জেলা ও মহানগরীর প্রায় ৫০টির বেশি স্পটে মাদকের কেনাবেচা চলে। এছাড়া মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে মোটরসাইকেল বাহিনী নির্ধারিত স্থানে মাদক দ্রব্য পৌঁছে দেয় বলে জানা গেছে। তবে অভিযানের কারণে দাম বেড়েছে। খুলনা মহানগরীর সোনাডাঙ্গা, বানরগাতি, পৈপাড়া, বসুপাড়া, দৌলতপুর, কল্পতরু মার্কেট, মহেশ্বরপাশা, খালিশপুর নতুন রাস্তা কাশিপুর, খালিশপুর মহিলা পলিটেকনিক কলেজের মোড়, চরের হাট, সোনাডাঙ্গা গীর্জার কাছের হরিজন কলোনী, সেলার এনার্জি পার্ক, শিববড়ি মোড়, শেখ পাড়া, তেঁতুল তলা মোড়, পাওয়ার হাউজ মোড়ের গলি, কেসিসি সুপার মার্কেট এলাকা, কাস্টম ঘাট, জেলা স্কুলের কাছের গলি, পিটিআই মোড়, কর্মাস কলেজের মোড়, ক্লাব পাড়া, রয়েল মোড়ের বিপরীতে, দোলখোলা, সাত রাস্তার মোড়ের গরীব নেওযাজ ক্লিনিকের গলি, বিএল কলেজের সামনের রেল লাইন এলাকা, বৈকালী রেল ষ্টেশন, বয়রা বাজার এলাকা, মোস্তর মোড়, মুসলমানপাড়া বাঁশ তলা এলাকা উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া খুলনার নয় উপজেলার মধ্যে ডুমুরিয়া উপজেলা এলাকা মাদকের রুট হিসেবে চিহ্নিত। ডুমুরিয়া বাজারের কালীবাড়ি মোড় , খাদ্য গুদাম এলাকা, আরাজি ডুমুরিয়া, সাজিয়াড়া, মির্জাপুর, ও চুকনগর বাজার মাদকের রাজধানী বলে চিহ্নিত। এ সকল স্থানে অভিযানের মধ্যে মাদকের কেনাবেচা কিছুটা কমে গেলেও বর্তমানে আবারও শুরু হয়েছে বলে স্থানীয়দের সাথে আলাপকালে জানা গেছে।
কয়েকটি স্পট ঘুরে দেখা গেছে, মাদক বিক্রেতাদের আনাগোনা কমেছে। কিন্তু স্পটগুলোর আশপাশেই গাঁজা, হেরোইনসহ বিভিন্ন মাদক নিয়ে অবস্থান করছেন বিক্রেতারা। এসব স্পটে আসা নিয়মিত ক্রেতা যারা, তারা আগে থেকেই যোগাযোগ করে মাদক সংগ্রহ করছে। আর যারা নিয়মিত নন, তারা স্পটগুলোতে একটু সময় ঘোরাফেরা করলেই আশপাশে থাকা মাদক বিক্রতেরা কখনো ইশারায়, আবার কখনো নানা রকম সংকেতের মাধ্যমে তাদের ডেকে নিচ্ছেন আড়ালে। তারপর চলে মাদক বিক্রি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে, মাদক বিক্রেতাদের তালিকায় তেরখাদা, রূপসা ও দিঘলিয়া উপজেলার একজন করে ইউপি চেয়ারম্যান, রূপসার একটি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, জেলা যুবলীগের একজন শীর্ষ নেতা, দাকোপ উপজেলা ছাত্রলীগের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা, জেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতা, দিঘলিয়ার একজন ছাত্রলীগ কর্মী, দাকোপের বানিয়াশান্তা বাজারের এক বাসিন্দা, চালনা বাজার দাকোপের একজনের নাম আছে। এছাড়া তেরখাদার কাটেঙ্গা এলাকার দুই জনের নাম আছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় নগরীতে ১৫৪ জন মাদক বিক্রেতা ও চোরাকারবারির নাম রয়েছে। একাধিক কর্মকর্তা এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এমনকি তারা নামগুলোও প্রকাশ করেছেন।
এই তালিকায় আছে ক্ষতাসীন দলের অনেক নেতার নাম, ছাত্র সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন, জনপ্রতিনিধি ও পুলিশ কর্মকর্তা। যদিও গুটি কয়েক মাদক বিক্রেতা গ্রেফতার হলেও প্রভাবশালীরা রয়ে গেছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
১৯ জুন পর্যন্ত জেলা পুলিশ ৩২১ জন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে। এ সময়ে উদ্ধার হয়েছে ৮৩৮ পিছ ইয়াবা, কেজি ৮০০ গ্রাম গাঁজা, ৩টি গাঁজা গাছ, সাড়ে ১৫ লিটার চোলাই মদ। ৪টি ককটেল, ১টি এয়ারগান, ৪ রাউন্ড গুলি, ৩টি মোটর সাইকেল। তিনি বলেন, ‘এ ঘটনায় ২৫৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।’
অপরদিকে নগর গোয়েন্দা পুলিশ বিশেষ অভিযান চলাকালে ১৪জন মাদক বিক্রেতাকে গ্রেফতার ও এ সংক্রান্ত ১৩টি মামলা দায়ের করেছে। এ সময়ে উদ্ধার হয়েছে ৩৩৫ পিছ ইয়াবা, ১০০ গ্রাম গাঁজা, ৭ বোতল ফেন্সিডিল, ২ গ্রম হিরোইন।
জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রাশেদুজ্জামান বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে এ সব তালিকাভূক্ত মাদক বিক্রেতাদের নজরদারিতে রেখেছি। তাদের সকলের গতিবিধি আমাদের নজরে রয়েছে। মাদক কারবারিদের আইনের আওতায় আনতে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
খুলনা জেলা পলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আনিচুর রহমান জানান, ‘গত মে মাসের ১৮ তারিখ থেকে সারাদেশের ন্যায় জেলা পুলিশ বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছে। মাদক বিরোধী অভিযান চলমান প্রক্রিয়া। মাদক বিক্রেতা ও সেবনকারীদের কোন ছাড় দেয়া হবে না।’
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ- পুলিশ কমিশনার ( গোয়েন্দা শাখা) এ এম কামরুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমান সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি মাদক বিরোধী অভিযান বেগবান করেছে। নগরীতে মাদকের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে যে কোন পদক্ষেপ নিতে পুলিশ দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’