নিজস্ব প্রতিনিধিঃরাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশন। প্ল্যাটফর্মে অন্য আরো কয়েকটি ট্রেনের মতো দাঁড়িয়ে চট্টগ্রামগামী সুবর্ণ এক্সপ্রেস। সাদা-লাল-সবুজ রঙা ট্রেনের ২২টি বগিতে হাজারের বেশি আসন। ট্রেন ছাড়ার নির্দিষ্ট সময় বিকেল ৩টা। দুপুর সোয়া ২টায় ট্রেনে উঠে দেখা গেল, বিভিন্ন বগিতে যাত্রীরা আগেই উঠে বসে আছে। তীব্র গরমে তারা ঘামছে। কোনো বগিতেই ফ্যান চলছে না। চার বছরের ছেলে সোহানকে নিয়ে তার মা আম্বিয়া বেগম এখান থেকে ওখানে পায়চারি করছেন। বললেন, ‘ছেলেটা ঘামতে ঘামতে কানতেও পারতাছে না।’
বন্ধ ফ্যানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ফ্যানগুলা আগে ছাইড়া দিলে কী হয়?’ ওই সময় ট্রেনের অ্যাটেনডেন্ট মো. আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে দেখা হলে তিনি বললেন, আড়াইটার আগে ফ্যান চালানো হবে না। ঘেমে অস্থির যাত্রীদের একজন শারমীন আক্তার বললেন, ঘামলেও ভিড় ঠেলে উঠতে হলো না, এটাই স্বস্তি।
ঈদ যাত্রায় গতকাল বৃহস্পতিবার রেলপথ, মহাসড়ক, নৌপথ ও আকাশপথে যাত্রীদের বেশ ভিড় ছিল। ঢাকা ও এর আশপাশের নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গী, গাজীপুর, আশুলিয়াসহ বিভিন্ন স্থান থেকে পোশাক শ্রমিকরা এদিন বাড়িমুখো হওয়ায় ভিড় আগের চেয়ে বেড়ে যায়। তবে বিকেল পর্যন্ত যানজটে পড়ে নাকাল হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি। ট্রেনের সময়সূচি ভেঙে পড়েছিল বিভিন্ন স্টেশনে যাত্রী তুলতে বেশি সময় নেওয়ায়।
ঢাকার কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলস্টেশনে যাত্রীদের ভিড় উপচে পড়েছিল। ভিড় ছিল গাবতলী, মহাখালী ও সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে। যাত্রীর কমতি ছিল না সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালেও। ভিড়ভাট্টা, অতিরিক্ত ভাড়া, আসন না পেয়ে দাঁড়িয়ে কিংবা বাস-ট্রেনের ছাদে ভ্রমণ করলেও যাত্রীদের মনে ছিল অমলিন হাসি। তাদের কাছে বাড়ি যাওয়ার আনন্দটাই বড় হয়ে উঠেছিল।
নারায়ণগঞ্জ থেকে লোকাল ট্রেনে কমলাপুর রেলস্টেশনে নেমে প্ল্যাটফর্মের পাশে সকাল থেকেই অপেক্ষা করছিল ১৭ জন সহকর্মীর একটি দল। সকাল থেকে দুপুর গড়ালেও তারা কোনো ট্রেনে ওঠেনি। গরমে অস্থির হয়েও স্থির বসে ছিল। কাছে এগিয়ে জিজ্ঞেস করতেই তাদের একজন মাসুদ রানা বললেন, তাঁদের কাছে ট্রেনের টিকিট নেই। কমলাপুর থেকে যেকোনো ট্রেনে বিনা টিকিটে উঠে বিমানবন্দর রেলস্টেশন নেমে যাবেন। বিমানবন্দর সড়ক থেকে দুটি মাইক্রোবাসে উঠবেন। তাঁরা যাবেন লালমনিরহাটের ডোমারে। প্রতিটি মাইক্রোবাস ভাড়া করা হয়েছে ২২ হাজার টাকায়। মাসুদ বললেন, কষ্ট নেই, ভালো লাগছে।
পাঁচটি বিশেষ ট্রেনসহ ৬৯টি ট্রেন ঢাকা ছাড়ে সারা দিনে। গতকাল দুপুর ২টার মধ্যেই কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ৩০টি ট্রেন ছেড়ে যায়। যাত্রীদের সবচেয়ে বেশি ভিড় দেখা গেছে উত্তরাঞ্চলমুখী বিভিন্ন ট্রেনে। রাজশাহী এক্সপ্রেস ট্রেনে ওঠার জন্য সকাল ৮টা থেকেই স্টেশনে বসে ছিলেন আতাউর রহমান। পরিবারের চার সদস্যকে নিয়ে টিকিট কেটেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ যাওয়ার জন্য। প্রতিটি টিকিটের দাম রাখা হয়েছে ১৩০ টাকা। আতাউর বলেন, এটা দাঁড়িয়ে যাওয়ার টিকিট। ১২টা ২০ মিনিটে ট্রেন ছাড়ার কথা, ছাড়েনি—অপেক্ষায় আছি। তিনি বলেন, ঈদে বাড়ি যেতে পারছি, এতেই খুশি। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কমলাপুরে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ট্রেনের ইঞ্জিনের ঘরে দাঁড়িয়ে, মেঝেতে বসে, ছাদে বসে, বাথরুমের ভেতরে ঢুকে যাত্রীরা বাড়ির দিকে ছুটছে। পাদানিতে ঝুলে, ইঞ্জিনের সামনে ও পেছনে যাত্রীদের ভিড় ছিল।
ট্রেন ছাড়তে গতকাল আগের দিনের চেয়ে বেশি বিলম্ব হচ্ছিল বিভিন্ন ট্রেনের। বাংলাদেশ রেলওয়ের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের তথ্যানুসারে, নীলসাগর ট্রেনটি তিন ঘণ্টা ২০ মিনিট দেরিতে ছেড়ে যায়। বিমানবন্দর রেলস্টেশন থেকে বহু যাত্রী আগেই ট্রেনে উঠে বসে ছিল। লালমনিরহাটমুখী বিশেষ ট্রেনও তিন ঘণ্টা বিলম্বে ছাড়ে। রাজশাহীগামী ধূমকেতু ছাড়ে ৫৫ মিনিট দেরিতে, খুলনাগামী সুন্দরবন এক ঘণ্টা, রংপুরমুখী রংপুর এক্সপ্রেস দেড় ঘণ্টা, দিনাজপুরগামী একতা ৩৫ মিনিট দেরিতে ছাড়ে।