রবিবার, ০২ এপ্রিল ২০২৩, ০২:২৯ অপরাহ্ন

ভাগাড়ের মাংস, ভেজাল খাদ্য ও পকেট ভারী সংস্কৃতি

ক্রাইম ফোকাস ডেস্ক :
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১৪ জুন, ২০১৮
  • ১২৮ বার পড়া হয়েছে

সাঈদ সরকার: হোটেল-রেস্তোরাঁয় ভাগাড়ের মাংস পাওয়া নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বেশ কিছুদিন ধরে তোলপাড় চলছে। খাদ্যে ভেজালবিরোধী অভিযান চালাতে গিয়ে ভাগাড়ের মাংসের তেলেসমাতি কারবারের দেখা পায় কর্তৃপক্ষ। এ অপরাধে অভিযুক্ত ছোট-বড় বহু হোটেল-রেস্তোরাঁ। একের পর এক রেস্তোরাঁর নাম প্রকাশ পেয়েছে আর পশ্চিমবঙ্গে মানুষ আঁতকে উঠেছে। পয়সা খসিয়ে এতদিন তারা তৃপ্তি করে ভাগাড়ের মাংস খেয়েছে!
সংবাদমাধ্যম মারফত এ নিয়ে যেসব খবর বেরিয়েছে, তা দেখে আঁতকে না উঠে পারা যায় না। এপ্রিলে ভাগাড়ের মরা পশুর মাংস হোটেল, রেস্তোরাঁর কাছে বিক্রি করে এমন একটি চক্রের কয়েকজনকে আটক করে কলকাতা পুলিশ। কলকাতার বজবজ এলাকায় ঘটনাক্রমে চক্রটির সন্ধান পায় পুলিশ। বজবজে একটি বহু পুরনো ভাগাড় রয়েছে, যেখানে গরু, মহিষ, ছাগল, বিড়াল, কুকুরসহ সব মৃত পশুর দেহ এনে ফেলা হয়। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ ও অনুসন্ধানে জানতে পেরেছে, চক্রটি কয়েক বছর ধরে কলকাতার আশপাশের ভাগাড় থেকে রাতের বেলা মৃত পশুর মাংস সংগ্রহ করে আসছে। এসব মৃত পশুর মাংস কেমিক্যাল দিয়ে দুর্গন্ধমুক্ত করে, তাজা মাংসের সঙ্গে মিলিয়ে হিমায়িত করে দোকানে, রেস্তোরাঁয়, ফুটপাতের কাবাব রোলের দোকানগুলোয় সরবরাহ করত। পুলিশের সন্দেহ, কিছু রেস্তোরাঁ ব্র্যান্ডেও যেত এ মাংস। সংবাদমাধ্যম ঘেঁটে যেসব তথ্য জানা গেল তা হলো, চক্রটি বেশ বড়সড়। কোনো এলাকায় পশু মরলেই ওই চক্রকে খবর দেয়ার জন্য ভাড়া করা লোক থাকত। তাদের কাছ থেকে খবর পেলেই পৌঁছে যেত সংগ্রহকারীরা। কলকাতা ও শহরতলি ছাড়াও হাওড়া ও হুগলির একাধিক জায়গায় এ মাংস সরবরাহ করা হতো। পুলিশের ধারণা, জাতীয় সড়কের ধারের দোকানগুলোয় এ মাংস পাঠানো হতো। এ ছাড়া বাজারে যে প্যাকেট করা ফ্রোজেন মাংস বিক্রি হয়, সেখানেও এ মৃত পশুর মাংস মেশানো হতো। শুধু ভাগাড়ের মরা পশুর মাংস নয়, পোলট্রি খামার থেকে মরা মুরগি কিনে তা সরবরাহ করা হতো বিভিন্ন রেস্তোরাঁসহ অন্যান্য জায়গায়। দালাল চক্রটি রেস্তোরাঁ ও মাংস সংগ্রহকারী চক্রটির মধ্যে মিডলম্যান হিসেবে কাজ করে। শুধু রেস্তোরাঁয় নয়, অনুষ্ঠান বাড়ি কিংবা হোম ডেলিভারির ক্ষেত্রে জ্যান্ত মুরগির সঙ্গে মরা মুরগি মিশিয়ে সরবরাহ করত দালাল চক্রটি।
আরো আঁতকে ওঠা খবর হলো, শুধু কলকাতা নয়, সীমান্ত পেরিয়ে মৃত পশুর মাংস নাকি পাঠানো হচ্ছে বাংলাদেশেও। কলকাতার বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় ভাগাড়ের মাংস সরবরাহকারী চক্রের কয়েক সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ। তাদের কাছ থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশের মাংস ব্যবসায়ীদেরও তারা সরবরাহ করে। গরু ও মহিষের মাংসের সঙ্গে চোরাই পথে প্যাকেটে করে ওই মাংস পৌঁছে দেয়। জানা গেছে, এ মাংস সাধারণত বাংলাদেশে আসত প্যাকেটজাত হয়ে টুকরো আকারে। যা গরু ও খাসির মাংসের নামে স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে পৌঁছে দেয়া হতো হোটেল, রেস্তোরাঁ ও সুপারশপগুলোয় (দৈনিক ইত্তেফাক, অনলাইন, ২৮ এপ্রিল)। শুধু বাংলাদেশই নয়, নেপালেও রফতানি করা টাটকা মাংসের সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হতো এ ভাগাড়ের পচা মাংস। ভাগাড়ের পচা মাংসের আন্তর্জাতিক কারবার।
মরা মাংস বিক্রি করে করে আয়ও কিন্তু হয় দারুণ। এমনকি কোটিপতিও হওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গে এমন একজনকে পাওয়া গেছে। নাম বিশ্বনাথ ঘড়ুই ওরফে বিশু। সহযোগীদের সাহায্যে ভাগাড়ের মরা পশুর মাংস বেচে কোটিপতি হয়েছেন এ বিশু। দমদম বিমানবন্দর ও বাঁকুরাসংলগ্ন একটি বড় খাটালে থাকা মৃত পশুগুলো তুলে নিয়ে দুটি ভাঙা বাড়িতে রাখা হতো। এরপর সেগুলো গাড়িতে করে মধ্যম গ্রাম থেকে রাতের অন্ধকারে তা অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো। তারপর সেই ভাগাড়ের মৃত পশুর মাংস বিক্রির জন্য বাজারে চলে যেত। ধরা পড়ার আগে এভাবেই চলত বিশুর ব্যবসা। এ ব্যবসা করে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জনের ফলে শহর ও শহরতলির বিভিন্ন প্রান্তে অন্তত চারটি বাড়ির মালিকও হয়েছেন বিশু। এ ছাড়া গড়িয়া স্টেশনের কাছেও একটি ফ্ল্যাট রয়েছে তার। বিশুর মোটরসাইকেল এবং চার চাকার বড় গাড়িও রয়েছে। প্রায় ১০ বছর ধরে মৃত পশুর মাংসের এ ব্যবসা করছেন বিশু। মাছ ব্যবসার আড়ালে এ ব্যবসায় তার হাতেখড়ি। গড়িয়াহাট ও রাজাবাজারে তার মাছের আড়ত রয়েছে। সেই মাছ বিক্রি করতে গিয়েই ভাগাড়ের পচা মাংস পাচারের কাজ শুরু করেছিল বিশু। তার অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন সিকন্দার। প্রায় ২০ বছর ধরে এ কাজ করে হতদরিদ্র থেকে আজ সিকন্দর বেশ কয়েকটি গাড়ির মালিক হয়েছেন। এ থেকে আরেকটি বিষয় নিশ্চিত, পচা মাংস বিক্রি বেশ পুরনো একটি ধান্দা।

এবার ছোট করে নিজ দেশের হোটেল-রেস্তোরাঁর দিকে নজর দেয়া যাক। গোটা বছরই খাদ্যে ভেজালবিরোধী অভিযান চালানো হয়, তবে রমজানে এর সংখ্যা বাড়ে। অভিযান চালানোর ফলে সস্তা থেকে শুরু করে নামিদামি রেস্তোরাঁর যে ভয়ানক চিত্র সামনে আসে, তা দেখে বিষম খেতে হয়। দেখা যায়, খাদ্যে মেশানো হচ্ছে কাপড়ে দেয়া রঙ, ব্যবহার করা হচ্ছে মেয়াদোত্তীর্ণ মাংস, পচা ডিম, পুরনো খাওয়ার অযোগ্য তেল, আরো কত কী! খাওয়ার জায়গাটা যতই দৃষ্টিনন্দন হোক না কেন, হেঁশেল ঘরের অবস্থা নোংরার একশেষ। খাদ্যে মশা, মাছি, টিকটিকি সবই পড়ছে, ভাসছে। তবে পরিবেশনে কোনো ঘাটতি নেই। ঠিকঠাক পরিবেশনে ভোক্তার মন জয় হচ্ছে ঠিকই, সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে রেটিংও পাচ্ছে বেশ। আবার শতভাগ নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা দেয়া সুপারস্টোরগুলো পচা মাংস, মেয়াদোর্ত্তীণ খাবার রাখায় জরিমানা গুনছে। রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে ফল পাকানো, মাছ সংরক্ষণ, সাদা চালকে রঙ করে লাল করা, গুঁড়ো মসলায় অন্য দ্রব্য মেশানো, শ্যাম্পু ব্যবহার করে দুধ তৈরি, মহিষের মাংস গরুর মাংস, আর ছাগলের মাংস হয়ে যাচ্ছে খাসির মাংসÑ এগুলো ভেজালের মাত্র গুটি কয়েক উদাহরণ। আরো কতভাবে ও কত উপায়ে ভেজাল খাবার তৈরিতে পরিশ্রম ঢালা হচ্ছে, তার ইয়াত্তা নেই। যদি এ পরিশ্রম নিরাপদ খাদ্য তৈরিতে ব্যবহার হতো, কতই না ভালো হতো।

কেন ভাগাড়ের মাংস কেনেন রেস্তোরাঁর মালিকরা, কেনইবা খাদ্যে ভেজাল মেশান বিক্রেতারা? উত্তর একটাই, অনৈতিকভাবে বাড়তি পয়সা কামানো। কিন্তু এর ক্ষতিগুলো কি ভেবে দেখবেন না? ভেজাল ও পচা খাবার খেলে শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। তার মধ্যে রয়েছে পেটের সংক্রমণ থেকে শুরু করে মস্তিষ্কের জটিল সমস্যা, গ্যাস্ট্রিক, কিডনি অকেজো, ডায়াবেটিস, লিভার সিরোসিস, এমনকি ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধিও হতে পারে। অনিরাপদ খাদ্যের প্রভাব পড়ে সব প্রজন্মের বুদ্ধিমত্তা এবং শারীরিক শক্তি ও গঠনের ওপর। যারা বাড়তি মুনাফার আশায় খাদ্যে ভেজাল মেশানোর কাজে নিয়োজিত, তারা তো এ দেশেরই বাসিন্দা। তাদেরও পরিবার রয়েছে, তারা তো এ খাবারই খান। মনে রাখুন, আপনি যদি মাংস ভেজালকারী হন, তবে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে দুধ ভেজালকারী।

ভেজালের কারবার দেখে একটি কথাই মনে হয়, কী খাচ্ছি আমরা? পয়সা তো ঠিকই দিচ্ছি। পশ্চিমবঙ্গের ভাগাড়ের মাংস কেলেঙ্কারি দেখে চিন্তা আসে, বাংলাদেশে এমনটা হয় না তো? যে রোস্তারাঁ-হোটেলে মাংস খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছি, তা ভাগাড় থেকে আসা গরু-মুরগির পচা মাংস না তো? কিংবা অন্য কোনো প্রাণীর? মনে রাখা প্রয়োজন, পশ্চিমবঙ্গে ভাগাড়ের মাংসের বিষয়টি সামনে এসেছে মাত্র কয়েক দিন আগে, কিন্তু বহু বছর ধরে কুশীলবরা এ কাজ করে এসেছে। এ থেকে মুক্তির উপায় কি নেই?
শুধু হোটেল-রেস্তোরাঁ, সুপারশপ কিংবা দোকানে অভিযান চালিয়ে আর জেল-জরিমানা করে খাদ্যে ভেজাল রোধ করা সম্ভব নয়। প্রশাসনকে নজর দিতে হবে উৎসমুখে, গুঁড়িয়ে দিতে হবে তাদের কর্মকা-। এরা যেন কোনোভাবেই মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, সেজন্য নিতে হবে সব ব্যবস্থা। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতে কোনো ছাড় নয়। বিষয়টি অবহেলা করা মানে দিন শেষে নিজেরই ক্ষতি করা।
পাঁচ.
পশ্চিমবঙ্গে ভাগাড়ের মাংসের আতঙ্কে গ্রাহক কমে যাওয়ায় অধিকাংশ হোটেল-রেস্তোরাঁ বিপাকে পড়েছে। মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন ভোক্তারা। এ অবস্থায় সেখানকার একটি হোটেল দারুণ উদ্যোগ নিয়েছে। গ্রাহকের আস্থা অর্জনে মুরগি কাটার লাইভ ভিডিও দেখাচ্ছে ফুড প্যালেস নামের রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ। গ্রাহকের আস্থা অর্জনের ভালো উপায় বলতেই হয়! আমাদের দেশের রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ এটি ভেবে দেখতে পারে।
তবে যে যা-ই করুক না কেন, আমরা চাই ভেজালমুক্ত খাবার। প্রশাসনকে তো কাজ করতেই হবে, সঙ্গে শক্ত সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ভেজাল খাবার কী পরিমাণ ক্ষতি করে, তা জানিয়ে দিতে হবে সবাইকে। খাদ্য ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরে সচেতনতা তৈরিতে জোর দিতে হবে। সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য বাংলাদেশকে এ চ্যালেঞ্জ উতরে যেতেই হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর