রাজু আহমেদ:
সম্প্রতি এ প্লাস বাণিজ্যের কী সাংঘাতিক সর্বনাশা চিত্র উঠে এসেছে ভাইরাল হওয়া বেসরকারি টেলিভিশন মাছারাঙার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। এসবে আগামি নিয়ে শঙ্কা হয় না? বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের কবলে শিক্ষার মেরুদন্ড যখন নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল তখন জাতির আগমী নিয়ে শঙ্কা তীব্রতর ছিল। তবে আশার কথা, সম্প্রতি গত হওয়া কয়েকটি পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের উৎসবে কিছুটা ভাটি এসেছে বটে কিন্তু মহামারীর ধাক্কা থেকে শিক্ষাঙ্গন এখনো পুরোদস্তুর মুক্ত হতে পারেনি। প্রশ্নফাঁস চক্রের অল্প বিস্তর আনাগোনা এখনো অবশিষ্ট দেখছি। তবে অনৈতিকতার চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করে অর্থের বিনিময়ে পরীক্ষার ফলাফল পরিবর্তন কিংবা এ প্লাস পাইয়ে দেয়ার খবর জাঁতি হিসেবে এ বছরেই আমাদেরকে শুনতে হল এবং নৈতিকতা যে নির্বাসনে গেছে তা আরেকবার মিডিয়ার কল্যাণেপ্রমাণিত হল বোধহয়। রেজাল্ট পরিবর্তন চক্রে জড়িত বিভিন্ন স্তরের মানুষগুলোর বাচনভঙ্গি, ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ এবং অবৈধ পথে উপার্জিত আর্থিক স্বাবলম্বন দেখে মনে হয়েছে রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে অনৈতিকতার বীজ সুপ্ত ছিল তা এখন মূলীয় বৃক্ষে পরিণত হয়েছে। জবাবদিহীতা সংকুচিত হওয়ার কারণে বিশৃঙ্খলার ঢেউ মানুষের সামাজিক দায়বদ্ধতাকে, বিবেকের জবাদিহীতাকে এবং পদের শপথকে লঙ্গন করছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে এ নৈতিক অবদমনের দায় কার? চিরায়ত রীতিতে সরকার বিশেষ করে শিক্ষামন্ত্রীর কাঁধে দায় চাপিয়েই আমরা মুক্তি পেতে চাইব? এ ক্ষেত্রে কি আসলেই এদের দায় কিংবা তাদের যদি দায় থেকেও থাকে তবে কতটুকু ? সম্পূর্ণ দায়ের সিঁকিভাগ হবে? আমি শিক্ষাক্ষেত্রের অনৈতিকতার সাথে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক খুঁজে পাই কিন্তু দায় খুঁজে পাই না। শিক্ষার্থীদের বয়স শেখার। নীতি-নৈতিকতার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার পরিপক্কতা এখনো আসেনি। তাদের যা সেখানো হচ্ছে তাই তারা শিখছে এবং এর প্রতিফলন আগামীতে রাষ্ট্রমুখী হবে। সকল দায় অভিভাবক, কিছু অসাধু শিক্ষক এবং রাষ্ট্র মনোনীত কিছু দায়িত্বহীন অসৎ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর। কেন্দ্র থেকে যদি প্রশ্ন ফাঁস না হয় তবে শিক্ষার্থীদের কোন শক্তি আছে যাতে তারা ফাঁসকৃত প্রশ্নে পরিক্ষা দিতে পারবে? অভিভাবক যদি লাখ লাখ টাকা দিয়ে এ প্লাস না কেনে তবে কোন শিক্ষার্থীর ক্ষমতা আছে দু’আড়াই লাখ টাকা দিয়ে এ প্লাস কিনতে যাবে ? শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা যদি নৈতিক হয় তবে এমন কোন অভিভাবক, শিক্ষকের সাধ্য আছে বোর্ডে গিয়ে পরীক্ষার ফলাফল পরিবর্তনের কথা তুলবে? বোর্ড কর্তাদের ওপর দায়িত্বশীল কর্তারা যদি আন্তরিক হয় তবে এ অসাধু অধঃস্তন কর্তারা কোন সাহসে অনৈতিকতার পথে পা বাড়াবে ? শিক্ষামন্ত্রনালয়ের দায়িত্বশীলরা যদি নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে কঠোর থাকে তবে রাষ্ট্রের বেতনভূক্ত কোন কর্মকর্তা-কর্মচারীর জাতির ভবিষ্যত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনৈতিক কোন কাজ কার সাধ্য ও সক্ষমতা একেবারেই থাকার কথা নয়। মাদক গ্রহন করলে গ্রহীতা, সর্বোচ্চ একটা পরিবার ধ্বংস হয় কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে যে মাদকতা বিরাজ করছে তাতে গোটা জাতির ধ্বংসের দামামা বাজছে। মাদক নির্মূলে ক্রসাফায়ার দেয়া গেলে যারা অর্থের বিনিময়ে এ প্লাস বিক্রি করছে তাদের ক্রসফায়ার দেয়া কি জরুরী নয় ?
একটি দূরদৃষ্টি সম্পন্ন উন্নতির স্বপ্নবাজ জাঁতি কর্মরত ৫০-৬০ বছরের আমলা কিংবা বড় বড় কর্মকর্তা কেন্দ্রিক স্বপ্ন দেখে না কিংবা থাকাও উচিত নয়। উন্নত বিশ্বে যারা দৃষ্টান্ত তাদের স্বপ্ন আবর্তিত হয় তাদের শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক। অত্যন্ত সম্ভাবনার কথা, আমাদের দেশে যতজন শিক্ষার্থী আছে, বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে ততোজন জনসংখ্যাও নেই। কাজেই আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে যদি সম্পূর্ণ নৈতিক দক্ষ শিক্ষায় গড়ে তুলতে পারি তবে বাংলাদেশ রাতারাতি উন্নত বিশ্বে স্থান লাভ করবে। আর যদি রাষ্ট্র এ সম্ভাবনাকে পুরোপুরিভাবে সঠিক নির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হয় তবে শঙ্কার উচ্চশিখরে আমরাই থাকব। কেননা সম্ভাবনার অপর পিঠেই শঙ্কা বদ্ধভাবে লেপ্টে থাকে। প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে শিক্ষিতের হার বাড়ানো কিংবা অর্থের বিনিময়ে সর্বোচ্চ রেজাল্ট জাতিবিনাশী কর্মকান্ডের সূচনা করবে। একজন শিক্ষার্থী সারাবছর প্ররিশ্রম করে যদি এ প্লাস পায় কিংবা এ প্লাসের কাছাকাছি ভালো রেজাল্ট করে তবে তাতে তৃপ্তি আছে বটে কিন্তু সে যখন দেখবে ক্লাসের সবচেয়ে জঘণ্য শিক্ষার্থীও যে কোনভাবে তার চেয়ে ভালো ফলাফল অর্জন করেছে তখন তার মধ্যে নীতিবিতৃষ্ণা আসবেই। ভালোর সঙ্গ পেয়ে মন্দের ভালো হওয়ার সম্ভাবনা সসীম কিন্তু মন্দের সঙ্গ নিয়ে ভালো মন্দে পরিণত হওয়ার শঙ্কা অসীম। কাজেই অনৈতিকতা থেকে উত্তরণের পথ রাষ্ট্রকে খুঁজতেই হবে। এ দেশে সরকারি হিসেবে ২৬ লাখ শিক্ষিত বেকার। কাজেই রাষ্ট্রের প্রত্যেক অঙ্গ থেকে দুর্নীতিবাজ-নীতিহীনদের বিতাড়িত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কেননা দক্ষ-নৈতিক জনবল দিয়ে নীতিহীনদের শুন্যপদ পূরণের বিকল্প সন্তোজনকভাবেই মজুদ রয়েছে। প্রজাতন্ত্রের অধিক সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী যখন অনৈতিকতার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করতে শুরু করে তখন সেটা সহকর্মীদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়। আর একবার যদি অনৈতিকা প্রতিযোগায় মাতে তখন সামগ্রিক শৃঙ্খলার পতন অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। রাষ্ট্রের হালচাল দেখে মনে হচ্ছে রাষ্ট্র বর্তমানে এ হালে চলছে। নইলে শিক্ষাক্ষেত্রে, যার সাথে দেশের ভবিষ্যত সংশ্লিষ্ট সেথায় এমন বিচ্যূতি প্রতিভাত হবে কেন ?
রাষ্ট্র যদি স্বপ্ন ভুলে যায় তবে বাড়তি কিছু বলার নেই বরং যখন যেভাবে চলে চলুক কিন্তু যদি উন্নতির স্বপ্ন থাকে কিংবা একটি নীতিবান জাঁতি পেতে আশা করে তবে অবশ্যই শিক্ষাখাতের দুর্নীতিকে সর্বাগ্রে সমূলে উৎপাটন করতে হবে। শতভাগ পাশ, বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দেয়া কিংবা বাজেটে শিক্ষার উন্নয়নে বিশাল অঙ্কের অর্থ বরাদ্ধ করার কোন অর্থ নাই যদি শিক্ষাক্ষেত্রের সাথে সংশ্লিষ প্রতিটি ইট পর্যন্ত নীতিবান না হয়। অভিভাবকরা সন্তানদের জন্য যে এ প্লাসের পিছনে ছুটছে সে এ প্লাস বোঝা হবে যদি সন্তান নৈতিক শিক্ষায় বড় না হয়, জ্ঞানের প্রশ্নে অজ্ঞ থাকে। যে শিক্ষার্থীর অভিভাবক টাকার বিনিময়ে সন্তানকে এ প্লাস কিনে দিচ্ছেন অপেক্ষা করুন এই সন্তান আপনাকে আরেকটু পরেই ঘরছাড়া করবে। যে সন্তানকে আপনি নৈতিক শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন সে সন্তান তার দায়িত্বে নৈতিক থাকবে সে আশায় গুঁড়েবালি। অপেক্ষা করুন, ঘটবেই। ছন্দপতনের এত কেবল সকাল, দুপুর গড়িয়ে বিকাল আসতে এখনো কিছুটা বাকি…।
রাজু আহমেদ। কলামিষ্ট।