নিজস্ব প্রতিনিধিঃ ঘরে ১০ বছরের ছোট মেয়ে। ক’দিন আগে ফোন করে বলে, ‘তুমি কি বাবা? প্রথম রোজায় বাড়ি আসার কথা ছিল? বাবা তুমি এমন কেন? তোমার কোনো দায়িত্ব নেই? সবাই বাবার সঙ্গে ইফতার করে, একসঙ্গে ঈদ করে। আমারো তো মন চায় বাবা?’ মেয়ের কথা শুনে চোখ ভরে ওঠে জলে। কিন্তু মেয়েকে বলতে পারিনি, ‘মারে! আমার যে ছুটি নেইরে মা।’ কান্না ভেজা কণ্ঠে নিজের কষ্টের কথা বলেন উত্তরার জসিমউদ্দিন পুলিশ বক্সের দায়িত্বে থাকা এক ট্রাফিক। এমনটা শুধু গল্পে নয়, বাস্তবই তো গল্পের সংলাপ। একজন ট্রাফিক পুলিশের জীবন যে কত কষ্টের, তা উপলদ্ধি করা যায় বাবা-মেয়ের কথায়।
শত দুঃখ কষ্ট, অসুস্থতা, হাজারো বিড়ম্বনার যেন শেষ নেই ট্রাফিক পুলিশের। চাকরির শুরুতেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ- নিজ দায়িত্বে পিছ পা হবেন না এক বিন্দুও। তাই দায়িত্ব পালন করেই যেতে হয় তাদের। প্রতিনিয়ত মৃত্যুকে সঙ্গে নিয়েই কাজ করে যান ট্রাফিক পুলিশ। দায়িত্ব পালনে অনেক সময় সড়ক দুর্ঘটনায় অকালেই হারাতে হয় জীবন। প্রাকৃতিক হোক আর মানবসৃষ্টই হোক, যে কোনো দুর্যোগেও দায়িত্ব পালনে নেই কোনো বিরতি ও অবহেলা। ধুলোবালি আর রোদ-বৃষ্টি, উচ্চ শব্দ সব কিছু মাথায় নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রমের পরও কখনো কখনো ট্রাফিক জ্যামের জন্য নীরবে শুনতে হয় অপবাদ। তখন কষ্টের শেষ থাকে না। কর্মের প্রতি দেখা দেয় অনিহা। দিন-রাত রাস্তায় থেকে অনেক সময় তারা আক্রান্ত হচ্ছেন নানা রোগে। এসব মানুষের ছুটি হয় কি সময় মতো? সবার মতো পরিবার-পরিজনের সঙ্গে বসে খাওয়া হয় কি ইফতার? ঈদের নতুন পোশাক নিয়ে আদরের সন্তানদের সঙ্গে ক’টা দিন কি আনন্দে কাটাতে পারেন? এমন অনেক প্রশ্নের জবাব হয়তো নেই। অনেক পেশার মানুষই হয়তো এভাবেই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। হয়তো তাদেরও কোনো খোঁজ অনেকেই রাখেন না।
সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন পুলিশ বক্স ঘুরে জানা যায়, রমজানে চাপ কম থাকলে শান্তিতে রোজা রেখে কাজ করতে পারেন ট্রাফিক পুলিশরা। কিন্তু উল্টো সারা বছরের তুলনায় রমজানেই চাপ আরো দ্বিগুণ হয়।
ইফতারের বাকি আর মাত্র ১৫ মিনিট। এদিক-ওদিক ছুটে চলা যানবাহন নিন্ত্রয়ণে তৎপর ট্রাফিক পুলিশ। ইফতারের সময় পার হলেও, চলে গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণের কাজ। কখন যে ইফতারের সময় পার হয়, তাও টের পায় না অনেক ট্রাফিক পুলিশ। আবার কাউকে দেখা যায় এক মুঠো শক্ত মুড়ি অনেক কষ্টে চিবিয়ে খেতে খেতে করছেন ট্রাফিকিং। পরিবারের সঙ্গে বসে ইফতারের ইচ্ছা থাকলেও, সারাদিন রোজা রেখে আপজন ছাড়াই সারতে হয় ইফতার। ঘরে কিংবা ভালো পরিবেশে ইফতারের ভাগ্য যেন নেই তাদের। বাধ্য হয়ে কখনো রাস্তায়, কখনো সড়ক দ্বীপে অথবা পুলিশ বক্সে বসেই ইফতার করেন ট্রাফিকরা।
ইফতার মানে এক ধরনের উৎসবের আমেজ। ঘরে-বাইরে সবখানেই চলে রকমারি ও সুস্বাদু ইফতারের আয়োজন। কিন্তু ঠিক তার ভিন্ন চিত্র, ট্রাফিক পুলিশদের বেলায়। প্রতিদিনই ইফতার করতে হয় রাস্তায়। রোদ, বৃষ্টি এমনকি ঝড়-তুফানেও দায়িত্ব পালন করতে হয় তাদের। ঢাকার ব্যস্ততম সড়কগুলোকে সচল রাখতে বিরাম নেই পুলিশের এসব সদস্যদের।
নগরীর এক পুলিশ বক্সে গিয়ে দেখা যায়, পুলিশ সদর দফতর থেকে পাঠানো হয়েছে ইফতার। ইফতারের মধ্যে রয়েছে একটি বেগুনি, আলুর চপ, কলা, জিলাপি, সামান্য ছোলা এবং সঙ্গে কিছু মুড়ি। খাবারগুলো যে গরম নেই, তা দেখেই বোঝা যায়। মুখে নেয়ার মতো অবস্থা নেই। সঙ্গে আছে এক বোতল পানি। কিন্তু সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে নেই কোনো ঠান্ডা কোমলপানীয়। আবার প্রায় সময় নিজের টাকায় কিনতে হয় ইফতার।
অথচ তীব্র রোদ, ধুলোবালি আর কালো ধোঁয়ার আচ্ছাদনে দাঁড়িয়ে অবিরাম বাঁশি ফুঁকে হাতের ইশারায় নিয়ন্ত্রণ করছেন যান। শিফট বদলে ২৪ ঘণ্টাই চলে ট্রাফিকিং। বাধ্য হয়েই তাদের রাস্তায় করতে হয় ইফতার। কিন্তু ট্রাফিক পুলিশদের ইফতার আয়োজনে নেই সরকারি বাজেট। নেই কোনো নির্দিষ্ট জায়গা।
বেশ কিছু ট্রাফিক পুলিশ সার্জেন্ট ও ইন্সপেক্টর হতাশার সুরে জানান, দায়িত্ব পালনে আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলেও সমস্যা। প্রতিদিনই প্রভাবশালীরা চলেন উল্টো পথে। অনেকের থাকে না প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। আটকালেই শুরু হয় বিপত্তি। শেষ থাকে না প্রভাবশালীদের হুমকি-ধমকি। কখনো কখনো ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে চাকরি খাওয়ারও হুমকিও দেন অনেকে। দেন নানা অপবাদ। মামলা করলে, বলা হয় ‘ঘুষ’ না দেয়ায় মামলা দেয়া হয়েছে। আর মামলা না করলে, বলা হয় ‘ঘুষ’ নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। যার অনেক চিত্রই বহু বার হয়েছে ফেসবুকে ভাইরাল। ট্রাফিক পুলিশের অভিমান, ‘এখন বলুন ভাই কোথায় যাব? ভালো কাজ করলেও দোষ; না করলেও দোষ!’
ঢাকা পূর্ব বিভাগের ট্রাফিক সার্জেন্ট রবিউল ইসলাম বলেন, রমজানের প্রথম দিন থেকে বিভিন্ন বিপণি বিতানে কেনাকাটা শুরু হয়েছে। চলছে এখনো। বছরের এই সময়টা থাকতে হয় অনেক বেশি সর্তক। বৃষ্টিতে ভিজেও নাগরিক চলাচল স্বাভাবিক রাখতে হয়। একমুঠো মুড়ি মুখে দিয়েই দৌড়াচ্ছি মানুষের চলাচল স্বাভাবিক রাখতে। ঠাণ্ডা ও অনুপযোগী খাবার, তবুও খেতে হয় রোজা থাকায়।’
খিলক্ষেতে দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জেন্ট নূরু আলম বলেন, অনেক কষ্ট করে রাস্তায় দায়িত্বরত অবস্থায় ইফতার করতে হয়রে ভাই। রমজানে ইফতারের সময়ও ছুটি মেলে না। আজান হলে কোনো রকমে পানি মুখে নিয়েই রাস্তায় দাঁড়াতে হয়। কি আর বলবো বলুন, চাকরি তো করছি নাগরিক সেবায়। এটাই আমাদের বাস্তবতা।