পাবনা প্রতিনিধিঃ ঈদ এলেই ঈশ্বরদী শহরের ফতে মোহাম্মদপুর এলাকার প্রতিটি ঘরে বেনারসি তৈরির ধুম পড়ে যায়। রাজধানীর মিরপুরের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পাবনার ঈশ্বরদী বেনারসি পল্লীতে এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
তাঁতিরা ঈদের অর্ডারের শাড়ি-কাপড় তৈরিতে মহাব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বেনারসি পল্লীর চার শতাধিক কারখানায় প্রায় এক হাজার বেনারসি শ্রমিক দিন-রাত ধরে কাজ করে চলেছেন। কারণ ঈদের আগে তাদের টার্গেট পূরণ করতে হবে। নারী শ্রমিক এমনকি বাড়ির বৌ-ঝিরা বিভিন্ন ধরনের শাড়িতে পুঁতি ও কারচুপির কাজ করা নিয়ে ব্যস্ত।
এবারের ঈদ উপলক্ষে ঈশ্বরদী বেনারসি পল্লীতে লেহেঙ্গা, অনারকলি ও ফুলকলি শাড়ি ছাড়াও নেট কাতান, পিওর কাতান কুমকুম, জানেবাহার, জর্জেট, প্রভৃতি নামের বাহারি শাড়ি তৈরি হচ্ছে। টাঙ্গাইল শাড়ির উপর নানা বাহারি সাজের কারুকাজ সমৃদ্ধ নানা দরের শাড়ি তৈরিতে পারদর্শী ঈশ্বরদীর বেনারসি পল্লীর নারী-পুরুষ শ্রমিকরা। ঈশ্বরদীর ঐতিহ্যবাহী বেনারসি-কাতান শাড়িতে এবারের অন্যতম আকর্ষণ জাবেদ কাতান-বেনারসী।
কারিগররা জানান, একটি বিশেষ ধরনের শাড়ি এবারে ঈদের আগ মুহুর্তে বাজারে তোলা হবে। সে শাড়িটির নাম এখনই তারা প্রকাশ করতে রাজি নন।
এখন প্রতি সপ্তাহে প্রায় এক হাজার পিস শাড়ি উঠছে মার্কেটে। ঈদ যত এগুবে তত বেশি শাড়ি মার্কেটে উঠবে। এক তাঁত মালিক জানালেন, এখানে তৈরি শাড়ি বনেদি বিপণী বিতানে ২০-৫০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে। ঈদে অন্তত ২০ কোটি টাকার শাড়ি এ পল্লী থেকে পাইকারি বিক্রি হবে বলে ব্যবসায়ীরা আশা করছেন। আগে যেখানে পাকিস্তান থেকে চোরাইপথে শাড়ি আসত এখন ঈশ্বরদীর তৈরি শাড়িই যাচ্ছে ভারত, পাকিস্তান ও নেপালে। দেশের মধ্যে রাজশাহী, খুলনা, কুষ্টিয়া, নাটোর, টাঙ্গাইল ইত্যাদি জেলায় যাচ্ছে। আগের চেয়ে আরোও উন্নতমানের বেনারসি তৈরি হচ্ছে বলে শ্রমিকরা জানান।
বেনারসী পল্লীর প্রবীণ তাঁতি জমির মালিথা বললেন, আগে ঈশ্বরদীর তাঁতিরা তৈরি করতেন বেনারসি-কাতান শাড়ি। এখন সেই শাড়িতে পুঁতি, পাথর ও জরির আকর্ষণীয় নকশা যোগ হওয়ায় এসব শাড়ির চাহিদা বেড়ে গেছে বহুগুণ।
ব্যবসায়ী জাবেদ বেনারসী জানান, তারা বেনারসি-কাতানের পাশাপাশি জর্জেট শাড়ির উপর বিভিন্ন নকশার কাজ করছেন। আগে ঢাকা থেকে তারা এসব নকশা নিয়ে আসতেন। এখন তারা স্থানীয়ভাবে নিজেদের ডিজাইনারদের দিয়ে শাড়ির নকশা করছেন। তিনি জানান, ঈশ্বরদী বেনারসি পল্লীতে ক্যালেন্ডার মেশিন না থাকায় এখানে তৈরি বেনারসি শাড়ি রাজধানী ঢাকার মিরপুরে নিয়ে ক্যালেন্ডার করে নিয়ে এসে বাজারজাত করতে হয়। এতে প্রতিটি শাড়ির জন্য ১০০-২০০ টাকা বেশি খরচ গুণতে হয়। তিনি জানান, ঈশ্বরদীর বেনারসি শাড়ি অনেক সময় মিরপুরের বলে বিক্রি করে থাকেন ঢাকার বিভিন্ন বিপণী বিতানের শাড়ি ব্যবসায়ীরা।
তরুণ ব্যবসায়ী সোহেল রানা জানান, শাড়ির এবার প্রচুর চাহিদা রয়েছে। তারা পর্যাপ্ত শাড়ি তৈরি করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। মধ্যম মানের কাতান, বেনারসি ও জর্জেট শাড়ি পাইকারি বিক্রি হচ্ছে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকায়। এসব শাড়ি বিভিন্ন দোকানে খুচরা বিক্রি হচ্ছে আট-দশ হাজার টাকায়।
ওয়াকিল আলম বেনারস জানান, এবার ঈদে ব্যবসায়ীদের জন্য সুসংবাদ, গত বছরও যেখানে বেনারসি শিল্পের জন্য কারিগর পাওয়া যাচ্ছিল না এবার সেখানে পেশা বদল করা লোকগুলো তাদের আগের পেশায় ফিরে এসে বেনারসি তৈরি করছেন।
বেনারসি পল্লীর শ্রমিক সোলেমান জানান, একটি শাড়ি তৈরিতে একজন শ্রমিকের ৩-৪দিন সময় লাগে। একজন বেনারসি শ্রমিক শাড়ি তৈরির কাজ করে সপ্তাহে ২০০০- ২৫০০ টাকা আয় করে থাকেন।
ঈশ্বরদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজিম উদ্দিন জানান, এ পল্লীর সামাজিক নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য তাদের নিয়মিত নজরদারি রয়েছে। এখানে উৎপাদক ও পাইকাররা যেন নিরাপদে ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারে সে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এছাড়া এখানে জাল টাকার লেন দেন যেন হতে না পারে সে জন্য নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
পাবনা চেম্বার অব কমার্সের সিনিয়র সহসভাপতি সনি বিশ্বাস বলেন, ভারত থেকে কিছু অসাধু ব্যাগেজ পার্টি ভারতীয় শাড়ি নিয়ে এসে আমাদের ঈশ্বরদীর শাড়ির ঐতিহ্যকে ধ্বংস করছে। বেনারসি পল্লীতে ৩ হাজার পরিবারের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে এবং এখানকার শাড়ির গুণগত মান উন্নত।
তিনি বলেন, আমরা পাবনা চেম্বার অব কমার্সের পক্ষ থেকে অবৈধ পণ্য প্রতিরোধ করে আমাদের ঈশ্বরদীর কাতান, বেনারসি সিল্ককে ধরে রাখব।