শনিবার, ২৫ মার্চ ২০২৩, ১২:৩৪ পূর্বাহ্ন

মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই

ক্রাইম ফোকাস ডেস্ক :
  • আপডেট সময় সোমবার, ১১ জুন, ২০১৮
  • ১৩৬ বার পড়া হয়েছে

ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী:

যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যেমন এর ইতিবাচক দিকগুলো বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে, তেমনি এর নেতিবাচক বিষয়গুলোও বিশ্লেষণ করা দরকার। যেকোনো ধরনের পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অনেক বিকল্প থাকে এবং এই বিকল্পের মধ্যে যেটি প্রয়োগ করলে পরিকল্পনা অনুযায়ী ফলাফল অর্জিত হবে, সেটিই বেছে নিতে হয়। আবার এই পরিকল্পনা স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে, যা নির্ভর করছে যে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে তার প্রকৃতির ওপর। যেমন সাম্প্রতিক সময়ে তিনটি বিষয়কে আমরা নেতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। এগুলো হলোÑজঙ্গিবাদ, মাদক ও দুর্নীতি। যেহেতু এগুলোর প্রকৃতি একটি থেকে অন্যটি অনেকাংশেই ভিন্ন ধরনের, সে ক্ষেত্রে এগুলোকে দমন করার জন্য ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্ত ও কৌশল গ্রহণ করতে হবে। এগুলো যেমন স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে দূর করার প্রচেষ্টা চালাতে হবে, তেমনি দীর্ঘ মেয়াদে এ সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে। যদি জঙ্গিবাদ ও মাদকের বিষয়টি আমরা চিন্তা করি, তবে এ দুটির সঙ্গে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রের যোগসূত্র রয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়।
একসময় সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি অস্ত্র ও প্রভাবের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে তাদের আগ্রাসন চালিয়েছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে এই কৌশল পরিবর্তিত হয়েছে। এখন জঙ্গিবাদ ও মাদক বিস্তারের মাধ্যমে একটি জাতিকে মেধাশূন্য করে কিভাবে তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করা যায় এই কৌশল তারা গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ যখন বর্তমান সরকারের বহুমাত্রিক পরিকল্পনার মাধ্যমে উন্নত রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করে চলেছে তখন আমাদের দেশের ওপরও অদৃশ্য শক্তি এই কৌশল বাস্তবায়নের চেষ্টা চালাচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি তাদের কৌশলকে বাস্তবায়িত হতে দেব, নাকি সেই কৌশলকে আমাদের ইতিবাচক চিন্তার মাধ্যমে কিভাবে সমাধান করা যায় তার প্রচেষ্টা চালাব। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই কলম্বিয়া, ফিলিপাইন, চীনসহ বিভিন্ন দেশে বিদেশি শক্তিগুলো এ ধরনের কৌশল অবলম্বন করেছিল। এ ক্ষেত্রে কখনো তারা সফল হয়েছে, কখনো বিফল হয়েছে। কিন্তু আগ্রাসনের ফলে জাতির স্বাধীন সত্তার বিকাশে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা কোনোভাবেই ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। মাদক ও জঙ্গিবাদের বিষয়টি যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তবে দেখব সেখানে তরুণ প্রজন্মকে বেছে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তরুণ প্রজন্মকে এ বিষয়ে বোঝানোর যে দায়িত্ব আমাদের ওপর ছিল, সেটি আমরা সেভাবে করতে পারিনি। এটি যে বাইরের ও ভেতরের অদৃশ্য শক্তির মাধ্যমে করা হচ্ছে, তা তরুণদের জানানোর মতো কোনো মাধ্যম ও পরিকল্পনা আমরা গ্রহণ করতে সক্ষম হইনি। এর ফলে তরুণরা মাদক ও জঙ্গিবাদের ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছে।
মাদক ও জঙ্গিবাদ কিভাবে একজন তরুণকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করতে পারে তার কোনো সমাজতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ আমরা তরুণদের জানাতে পারিনি। এর ফলে তার পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তার ফলাফলও তাদের আমরা জানাতে সক্ষম হইনি। এগুলো নিয়ে যেমন গবেষণা নেই, তেমনি আমাদের পাঠ্যপুস্তকে এগুলোকে সম্পৃক্ত করে সহজভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি ভারতবর্ষে আফিমের মাধ্যমে মাদকের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে চলে গেলেও তা এখন ক্ষমতাধর আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের হাতে চলে এসেছে। এ চক্র বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে তাদের মাদকের বাজার সম্প্রসারিত করে চলেছে। এই আন্তর্জাতিক চক্রের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি করে দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা তরুণদের ওপর মাদকের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু ইতিহাসের এ ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে এনে আমরা তাদের কাছে সেভাবে পৌঁছতে পারছি না। ফলে নিজের অজান্তেই যেমন তারা নিজেকে ধ্বংস করছে, তেমনি একটি জাতির স্বাধীন জাতিসত্তাকেও বিনষ্ট করছে। একসময় চীনকে যখন কোনোভাবেই সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি অস্ত্রের মাধ্যমে তাদের প্রভাববলয়ের মধ্যে আনতে পারেনি তখন সমগ্র চীনে আফিমের বিস্তার ঘটিয়ে তারা তরুণদের নেশায় আসক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। এর ফলে প্রচলিত যুদ্ধ ছাড়াই আফিম-যুদ্ধের মাধ্যমে বিদেশি শক্তি চীনে তাদের আধিপত্য বিস্তার করেছিল। একই ধরনের কৌশল অবলম্বনের চেষ্টা আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার করছে বলে ধারণা করা যেতে পারে। তবে এখানে তারা আফিমের বদলে ইয়াবাকে তাদের যুদ্ধের কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার তার সেনাবাহিনীকে দীর্ঘ সময় সচল বা উত্তেজিত রাখার জন্য মেথামফেটামাইন বা নাজিস্পিড সরবরাহ করত। সত্তরের দশকে এটি থাইল্যান্ডে তৈরি ও ব্যবহৃত হতে থাকে এবং তাদের মাধ্যমে এটি সারা এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু বর্তমানে এটি ইয়াবা নামে সবচেয়ে বেশি তৈরি হচ্ছে মিয়ানমারে। এটিকে তারা যেমন তাদের অর্থ উপার্জনের পন্থা হিসেবে বেছে নিয়েছে, তেমনি এর মাধ্যমে আমাদের দেশে তাদের অশুভ প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমাদের দেশের সুবিধাবাদী ও ষড়যন্ত্রকারী অপশক্তি। ঢাকা মহানগরীতে ইয়াবার চাহিদা ১৪ লাখের বেশি। একইভাবে চট্টগ্রাম মহানগরীতে এর চাহিদা আট লাখ এবং কক্সবাজারে চার লাখেরও বেশি। এ ছাড়া সারা দেশে এর চাহিদা বেড়েই চলেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমাদের তরুণদের আমরা এর ভয়াবহতা ও নেপথ্যের ভৌগোলিক রাজনীতির বিষয়টি সেভাবে বোঝাতে পারিনি। যদি আমরা তরুণদের বিষয়টি ইতিহাসের শিক্ষা থেকে বোঝাতে সক্ষম হই, তবে তাদের মধ্যে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ কাজ করবে, সেটি নির্দ্বিধায় বলা যায়।
বর্তমানে সরকার মাদকের বিরুদ্ধে যে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে, তা প্রশংসনীয় উদ্যোগ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। একইভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধেও দৃশ্যমান নীতি গ্রহণ করে একে দমন করার প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে হবে। অন্যদিকে জঙ্গিবাদের ফলে জঙ্গির পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র কিভাবে প্রভাবিত হচ্ছে, সেটির সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তরুণদের মধ্যে সহজভাবে বিভিন্ন উদাহরণের মাধ্যমে তুলে ধরে তাদের জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অনুপ্রাণিত করতে হবে। এখানে জঙ্গিবাদ সম্পর্কিত একটি বাস্তব ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। আবেদাতুল ফাতেমা তাঁর স্বামী তানভীর কাদেরীর প্রভাবে জঙ্গি তৎপরতায় সম্পৃক্ত হন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বসে এখনো তিনি জঙ্গিবাদের কারণে তাঁর সাজানো সংসার ভেঙে যাওয়ার অসহ্য যন্ত্রণা বহন করে চলছেন। ফাতেমা এখন প্রায়ই বলেন, জঙ্গিবাদের ভুল পথে চলে তাঁর সোনার সংসার পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। তিনি স্বামী হারিয়েছেন, দুই সন্তানের একজন প্রাণ হারিয়েছে। অন্যজনের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ততার কারণে পরিবারের আপনজনরাও তাঁদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তিনি নিজে উচ্চশিক্ষিত। আর তাঁর দুই সন্তান ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করত। মা হয়ে নিজের সন্তানের জীবনকে তিনি ধ্বংস করেছেন। এতে মানসিকভাবে তিনি ভেঙে পড়েছেন। এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে হবে এবং জঙ্গিবাদের ধারণা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে হবে। তবে এ সমস্যাগুলো স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে দমন করে বসে থাকলে চলবে না, বরং এগুলোর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে এ সমস্যাগুলো চিরতরে নির্মূল করতে হবে।
মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের দৃঢ় অবস্থান তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশ থেকে যেভাবে জঙ্গিবাদ দূর করা হয়েছে, একইভাবে মাদকও সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা হবে। সরকার সব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা, বিশেষ করে র‌্যাবকে মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর হতে নির্দেশ দিয়েছে এবং তারা কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। ছেলে-মেয়েরা যাতে যথাযথ শিক্ষার মাধ্যমে উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে পারে তার জন্য সরকার সব ধরনের সুবিধা প্রদান করছে। আমরা প্রতিটি ঘরে শান্তি ও সমৃদ্ধি দেখতে চাই। কেন আমাদের ছেলে-মেয়েরা বিপথে যাবে? যখন পরিবারের একজন সদস্য মাদকাসক্ত হয় তখন পুরো পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়। জঙ্গিবাদ দূর হয়েছে। এবার মাদক, এরপর দুর্নীতি নির্মূল করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনবান্ধব এই আন্দোলনগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ত করতে হবে। সম্মিলিত দেশপ্রেমের শক্তি অন্তরে ধারণ করে আমাদের এসব অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। আর এর মাধ্যমে শুভ বোধ জাগ্রত হোক এবং বাঙালির জয় নিশ্চিত হোক।

লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর