সরেজমিনে দেখা যায়, শহরের আদালত পাড়া, কোর্ট মসজিদ এলাকা, দূর্জয় হবিগঞ্জ প্রাঙ্গণ, হাসপাতাল এলাকা, টাউন হল রোড, বেবি স্ট্যান্ড এলাকা, বৃন্দাবন কলেজ ক্যাম্পাসসহ বিভিন্ন স্থানে দলবেঁধে ঘুরে বেড়ায় অসংখ্য পথশিশু। ভিক্ষাবৃত্তি, টোকাইবৃত্তির পাশাপাশি এরা প্রকাশ্যেই সেবন করে মরণনেশা ড্যান্ডি। মাঝে মাঝে তারা পথচারী ও স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের উত্যক্তও করে থাকে।
কথা হয় ১৫ বছর বয়সী এক ড্যান্ডি আক্রান্ত শিশুর সঙ্গে। সে জানায়, বাবা নেই, ঘরে বৃদ্ধ মা। ৫ ভাই-বোনের মধ্যে সে দ্বিতীয়। ছোট বোনকে নিয়ে টোকাইগিরি আর ভিক্ষা করেই তার জীবন কাটে পথে-ঘাটে। রাত হলে ঘুমিয়ে পড়ে সরকারি-বেসরকারি ভবনের বারান্দায়। অকপটে স্বীকার করে ড্যান্ডি সেবনের কথাও।
সে জানায়, তার অনেক সহপাঠী রয়েছে। তারা সবাই এক সঙ্গে মিলে ড্যান্ডি সেবন করে।
ওই শিশুটি আরো জানায়, তারা টাকার জন্য সবসময় ভাত কিনে খেতে পারে না। তাই যে কিছু টাকা ভিক্ষা করে পায় তাই দিয়ে ড্যান্ডি কিনে তা সেবন করে। ড্যান্ডি সেবন করলে তারা নেশার ঘুরে অনেক সময় কাটাতে পারে বলেও জানায়।
শিশুটি জানায়, ড্যান্ডি কিনতে তাদের মাত্র খরচ হয় ৮০ থেকে ৯০ টাকা। তা দিয়ে তারা সকলে মিলে ড্যান্ডি সেবন করতে পারে। ওই শিশুটির মতো পুরো শহরে রয়েছে এরকম অন্তত আরো অর্ধশতাধিক শিশু। এদের প্রায় সবাই ড্যান্ডি আসক্ত।
হবিগঞ্জ বি. কে. জি. সি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জেরিন আক্তার জানায়, প্রতিদিন স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে টাকা চেয়ে উত্যক্ত করে পথশিশুরা। টাকা না দিলে হাতে পায়ে জড়িয়ে ধরে, মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এতে তারা অনেক বিড়ম্বনার শিকার হন। শুধু তাই নয়, এরা প্রকাশ্যে দল বেঁধে সেবন করে মরণনেশা ড্যান্ডি। এতে অনেক শিক্ষার্থীর মনে কৌতুহলবশত ড্যান্ডি আসক্তি জাগতে পারে। অথচ বিষয়টি নিয়ে ভাবছে না কেউ।
হবিগঞ্জ সরকারি বৃন্দাবন কলেজের শিক্ষার্থী রোকশানা আক্তার জানান, ড্যান্ডি আসক্তি শিশুরা শুধু কলেজের গেইট কিংবা রাস্তায় না অনেক সময় ক্লাসের ভেতর টাকার জন্য প্রবেশ করে। টাকা না দিলো তারা ইটপাটকেল ছুড়ে।
ড্যান্ডি’র কুফল সম্পর্কে জানতে চাইলে হবিগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. দেবাশীষ দাশ জানান, ড্যান্ডি’র প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফুসফুস, লিভার, কিডনিসহ মানব দেহের নানা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এতে দেখা দিতে পারে ঝিমুনি, ক্ষুধামন্দা, শ্বাসকষ্টসহ নানা উপসর্গ। দীর্ঘদিন অতিমাত্রায় ড্যান্ডি সেবনে অকালমৃত্যুও ঘটতে পারে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) হবিগঞ্জ জেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট ত্রিলোক কান্তি চৌধুরী বিজন জানান, এসব পথশিশুদের দায়িত্ব এড়িয়ে চলছে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো। দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে আরো অনেকের জীবন এভাবেই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ অন্য শিশুদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে আসক্তি। এদের পুনর্বাসন করা জরুরি।
হবিগঞ্জ জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক একেএম দিদারুল আলম জানান, ড্যান্ডি যারা সেবন করে তারা সবাই শিশু। তাই তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। তবে যাদের অভিভাবক রয়েছে তাদের সঙ্গে কথা বলে ড্যান্ডি আক্রান্ত শিশুদের পুনর্বাসন করা হবে।
তিনি বলেন, যেহেতু ওই শিশুরা গামের (আটা জাতীয়) মাধ্যমে তা সেবন করে তাই তারা বিভিন্ন ভাবে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তা পেয়ে যায়। তবে এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও কথা বলব। যাতে করে ওইসব পথশিশুদের কাছে তারা তা বিক্রি না করেন।
সমাজসেবা অধিদফতর হবিগঞ্জের সহকারি পরিচালক মোহাম্মদ জালাল উদ্দীন জানান, পথশিশুদের পুনর্বাসনে কাজ করছে অধিদফতর। ড্যান্ডি আসক্ত শিশুদের ব্যাপারেও খোঁজ নেয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে হবিগঞ্জ পৌর এলাকায় ৯ জনের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তবে এরইমধ্যে তাদের কোনো তালিকা ছিল না।
তিনি আরো বলেন, জেলাজুড়ে তাদের তালিকা প্রণয়ণ করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হবে। এছাড়াও বেসরকারি সংস্থাসহ সমাজ সচেতন বিত্তবানদেরও এগিয়ে আসতে হবে। সমন্নিত উদ্যোগের ফলেই কেবল এ সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব।