কাজী মফিকুল ইসলাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া:বসতঘরের পাশে ছোট একটি রান্নাঘর, ঐ ঘরে রয়েছে মাটির চুলা। সে চুলায় রান্না হয় ঠিকই, তবে তা ভাত, মাছ বা মাংস নয়, মাটির চুলায় লোহার কড়াইয়ে তপ্ত বালুর ভেতরে রান্না হচ্ছে চাল। আর নাড়ানিতে করছে খচখচ শব্দ, পটপট শব্দে ফুটছে সাদা মুড়ি। সেই সঙ্গে পটপট শব্দে মুখর হয়ে উঠছে রান্নাঘর। এমন দৃশ্য দেখা যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া পৌর শহরের রাধানগর এলাকার সাহা পাড়ায়।
ঐ এলাকার অরুণ সাহা (৬০) নামে একজন দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে লোহার কড়াইয়ের মধ্যে রাসায়নিক পদার্থ ছাড়াই দেশীয় পদ্ধতিতে লবণ পানি আর বালু দিয়ে হাতের সাহায্যে তৈরি করছেন এই মুড়ি। মুড়ি ফোটার শব্দে যেন পাল্টে গেছে তার জীবনের ছন্দ। হাতের তৈরির মুড়ি পৌর শহরসহ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বেশ পরিচিতি লাভ করেছে। মুড়ির চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় দিনরাত তিনি খাটছেন। বর্তমানে তিনি এই মুড়ি বিক্রি করেই চলছে তার জীবিকা।
অরুণ সাহা ঐ এলাকার স্বর্গীয় হরিসন সাহার ছেলে। এক সময় এই পাড়ার অনেক লোকজন এ পেশার সঙ্গে জড়িত ছিল। কিন্তু পুঁজিসহ নানা কারণে তারা পেশা বদল করলেও বর্তমানে তিনিই ধরে রেখেছেন এ পেশা। এমনিতেই সারাবছর দেশীয় মুড়ির চাহিদা থাকলেও রমজান মাস আসায় চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় এখন তিনি ব্যস্ত সময় পার করছেন।

মুড়ি তৈরিতে ব্যস্ত নারী কর্মীরা-ছবি ডেইলি বাংলাদেশ
সরজমিনে রাধানগর অরুণ সাহার বাড়িতে দেখা যায়, মাটির চুলায় লোহার কড়াইয়ের মধ্যে কোনো রকম রাসায়নিক পদার্থ ছাড়াই দেশীয় পদ্ধতিতে লবণ পানি আর বালু দিয়ে নারীরা ঘাম ঝড়ানো পরিশ্রম করে মুড়ি তৈরি করছেন। এক চুলায় চলছে শুকনো বালু গরম করা, অপর চুলায় চলে হালকা করে চাল ভাঁজার কাজ। নারিকেল পাতার শলা দিয়ে নাড়াচাড়ার পর ভাজা চাল হালকা হলদে-বাদামি বর্ণের হলে উত্তপ্ত বালুর ওপর ঢেলে দেওয়া হয়। এরপর কড়াই নাড়াচাড়া দিতেই পট পট শব্দে ফুটে সাদা মুড়ি। জীবন-জীবিকার তাগিদে তিনি ছোটবেলা থেকেই মুড়ি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন। নারীরা মুড়ি তৈরির জন্য চাল শুকানো থেকে ভাজার কাজ করেন। আর তিনি নিজে সেসব বিক্রি করতে নিয়ে যায় বাজারে। সনাতন পদ্ধতিতে হাতে তৈরি মুড়িতেই চলছে তার সংসার। পরিবারে স্ত্রী ও ২ মেয়ে রয়েছে। হাতে মুড়ি ভেজে বিক্রি করায় এ এলাকাটি এখন ‘মুড়ির গ্রাম’ হিসেবে বেশ পরিচিতি পেয়েছে।
অরুণ সাহা বলেন, অন্য কোনো কাজের সুযোগ না থাকায় এখনো তিনি তাদের পূর্বের এ পেশা ধরে রেখেছেন। আজ থেকে ৪০ বছর ধরে তিনি দেশীয় পদ্ধতিতে হাতে ভাজা মুড়ি তৈরি করে বিভিন্ন হাট বাজারে বিক্রি করছেন। এখানে তিনজন নারী শ্রমিকসহ পরিবারের সদস্যরা এ কাজ করছেন। সারা বছরই স্থানীয়ভাবে এ মুড়ির চাহিদা রয়েছে। লবণ পানি আর বালু দিয়ে এই মুড়ি তৈরি করায় রাসায়নিকমুক্ত খাদ্যের জন্য মুড়ির সুনাম ও চাহিদা রয়েছে বেশ। শ্রমিকের অভাবে বেশি মুড়ি তৈরী করা যায় না। দৈনিক ২০ কেজি উপরের চালের মুড়ি ভাজা হয়। এ জন্য তিনজন নারী শ্রমিক সকাল থেকে দুপুর পযর্ন্ত মুড়ি ভাজার কাজ করেন। ঘণ্টায় তাদের দেওয়া হয় ৫০ টাকা। চাল, জ্বালানি, শ্রমিক খরচ বাদে প্রতি মাসে ১৫-১৭ হাজার টাকার উপর তার আয় হয়।
তিনি আরো বলেন রোজার শুরুতেই দেশি মুড়ির চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। কিন্তু পুঁজির অভাবে ঠিকমতো মুড়ি সরবরাহ করতে তিনি পারছেন না। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মুড়ি ভেজে স্থানীয় দোকান ও পাইকারদের কাছে বিক্রি করা হয়। মুড়ি বিক্রির টাকা দিয়েই তার চলছে সংসারের খরচ। স্থানীয় বাজারে পাইকারিতে ৮০ টাকা করে প্রতি কেজি মুড়ি বিক্রি করছেন।
সনাতনী প্রক্রিয়ায় মুড়ি ভাজা সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, মুড়ির চাল পানিতে ধুয়ে ধুলাবালি পরিষ্কার করতে হয়। এরপর পরিমাণমতো লবণ মিশিয়ে রোদে শুকানোর পর ভাজতে হয়। গরম বালুর ভেতর চাল ঢেলে নাড়তে থাকলে চাল ফুটে মুড়ি তৈরি হয়। পরে বালু আলাদা করলেই পাওয়া যায় সুস্বাদু মুড়ি।

হাতে তৈরিকৃত মুড়ি নিয়ে বাজারে ছুটছেন অরুণ সাহা-ছবি ডেইলি বাংলাদেশ
নারী শ্রমিক সবিতা রানী সুত্রধর বলেন, এখানে তিনি প্রায় ছয় বছর ধরে মুড়ি তৈরির কাজ করছেন। মূলত কাজের উপর নির্ভর হয়ে থাকে তাদের মজুরি। সকাল থেকে দুপুর পযর্ন্ত করছেন এই কাজ। তবে রমজান মাস এলে তাদের কাজের চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। মুড়ি তৈরির কাজ করে প্রতিমাসে ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা আয় করছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. মজিবুর রহমান বলেন, এক সময় এখানে অনেক লোকজন দেশীয় পদ্ধতিতে সুস্বাধু হাতের তৈরির মুড়ি ভাজতো। হাতে ভাজা মুড়ির ভালো জনপ্রিয়তা ছিল। তবে একটি পরিবার দীর্ঘ বছর ধরে হাতের তৈরি মুড়ি ভাজার কাজটি ধরে রেখেছেন। হাতের তৈরি মুড়ি তিনি সব সময় ক্রয় করেন।
ব্যবসায়ী মনোরঞ্জন দাস বলেন, তার দোকানে হাতের তৈরি মুড়ির ভালো চাহিদা রয়েছে। এখান থেকে কিনে নিয়ে তিনি বিক্রি করছেন। তবে দোকানে চাহিদানুযায়ী দেশি মুড়ি তেমন পাচ্ছেন না।