নিউজ ডেস্কঃ৬ আগস্ট ১৯৪৫। স্থানীয় সময় তখন সকাল ৮টা ১৫ মিনিট। তখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা তখন জোরেশোরে বাজছে। হিরোশিমার মানুষ তখনো জেগে ওঠেনি। একটু একটু করে ব্যস্ত জীবনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল হিরোশিমা। হঠাৎ দানবের মত হিরোশিমার আকাশে উদয় হলো মার্কিন বি-টুয়েন্টিনাইন বোমারু বিমান।
আগুন জ্বলা ড্রাগনের মত হিরোশিমার আকাশে বিস্ফারিত হলো প্রথম আণবিক বোমা ‘লিটল বয়’। বোমাটি প্রায় ৫০০ মিটার উঁচুতে বিস্ফোরিত হয়। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই আণবিক বোমার বিষাক্ত ছোবলে ছটফট করে মারা গেল ৮০ হাজার জাপানি। ঘুমের মধ্যে মারা গেল অগণিত শিশু, নারী, বৃদ্ধ বৃদ্ধা, যুবক যুবতী। আহত হলো ৫০ হাজারের উপর মানুষ।

ঠিক সকাল ৮টা ১৫ মিনিট হিরোশিমার আকাশে বিস্ফারিত হলো প্রথম আণবিক বোমা `লিটল বয়`
আগুনের লেলিহান শিখা দেখে শিউরে উঠলো বিশ্ব। মনে হলো পৃথিবীর শেষ দিন উপস্থিত। মাটির সঙ্গে মিশে গেল–বড় বড় অট্টালিকা কলকারখানা হাসপাতাল স্কুল কলেজ উপাসনাগৃহ। ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয় একটি নগরী। চারদিকে শুধু হাহাকার আর্তনাদ, চিৎকার, হাসপাতালের ডাক্তার নার্স সেবিকার দল ও যে নিশ্চিহ্ন হয়েছে, মৃত্যু গ্রাস করেছে সুন্দর শহর হিরোশিমা কে। আর কয়েক বছরের মধ্যে ভয়াবহ তেজস্ক্রিয়তায় পঙ্গু বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হলো, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেল অগণিত মানুষ।

বোমার ভয়াবহ তেজস্ক্রিয়তায় পঙ্গু বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হলো, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেল অগণিত মানুষ
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় বছর শেষে আরও ৬০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। আজও সেই দিনের নৃশংসতা মানুষকে অবাক করে। সেই অভিশাপ আজও বয়ে চলেছেন হিরোশিমার মানুষ হিরোশিমা এবং নাগাশাকি। যেখানে আবার পরমাণু বোমা আছড়ে পড়েছিল ৯ আগস্ট।
পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ইতিহাসে এই প্রথম। তাই তার প্রতিক্রিয়া কী কী হতে পারে, সে সম্বন্ধে কোনো ধারণাই ছিল না কারোর। যেন সাধারণ একটা বোমাই ফেটেছে শুধু। হ্যাঁ, তীব্রতা বেশ কিছুটা বেশি। মৃতের সংখ্যা বেশি। কিন্তু যারা আহত তাদের জন্য চিকিৎসার আয়োজন খুবই সামান্য। অথচ সমস্যার সমাধান তাতে হল না কিছুই?

কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় পুরো হিরোশিমা শহর
১৯৪৫ সালে ঘটল বিস্ফোরণ। কিন্তু তার প্রভাব কতটা দীর্ঘস্থায়ী ছিল তার একটা উদাহরণ পাওয়া যায় ১৯৪৮ সালের একটি ফোটগ্রাফে। তাতে দেখা যায় হিরোশিমার কয়েকজন শিশুকে। প্রত্যেকের মুখেই আছে মাস্ক। বর্তমানে ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে যেমন মাস্ক পরে রাস্তায় বেরোচ্ছি। তখনও ব্যবস্থা ছিল তেমনই। তবে তার কারণ কোনো ভাইরাস নয়। ৩ বছর আগে যে বিস্ফোরণ ঘটেছিল, তার ফলে তখনও ধোঁয়ায় ঢাকা ছিল শহর। কিন্তু যে ধোঁয়া যে ছিল পরমাণু বিস্ফোরণ থেকে সৃষ্টি। তাই মাস্কে তাকে আটকাতে পারার কথা নয়। কিন্তু এর থেকে বেশি কিছু তখনকার চিকিৎসকরা ভাবতে পারেননি।

যারা সেসময় বেঁচে গিয়েছে ইতিহাস তাদের মনে রেখেছে ‘হিবাকুশা’ নামে
হিরোশিমা বিস্ফোরণে এক মুহুর্তে অন্তত ২০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু এই পরিসংখ্যান দিয়ে হয়তো তার তীব্রতা কিছুই বোঝা যায় না। কারণ তার প্রভাব ছিল মূলত মানুষের জিনে। আর সেই প্রভাব চলেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। বিস্ফোরণের ফলে যেমন অনেকে বিকলাঙ্গ হয়ে পড়েছেন। তেমনই আবার পরবর্তী প্রজন্মে অনেকে জন্মেছেন বিকলাঙ্গ অবস্থায়। কারোর দৃষ্টিশক্তি নেই তো কারোর চামড়ার স্তর ক্রমশ ক্ষয়ে গিয়েছে।তাদের ভয়ংকর শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে বাকি জীবন কাটাতে হয়েছে। ইতিহাস তাদের মনে রেখেছে ‘হিবাকুশা’ নামে। তবে যুদ্ধের শিকার এই মানুষদের দুর্দশার ভেতর দিয়েই আমরা জানতে পেরেছি পারমাণবিক প্রভাবের নানা দিক।

হাজার হাজার ঘুমন্ত মানুষ মুহূর্তেই মারা যায় বোমার আঘাতে
হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে কত লোক মারা গিয়েছিল, তা মূলত আনুমানিক হিসেব। ধারণা করা হয় হিরোশিমা শহরের সাড়ে তিন লাখ মানুষের মধ্যে ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ কেবল বোমার বিস্ফোরণেই মারা যায়। আর নাগাসাকিতে মারা যায় ৭৪ হাজার মানুষ। তবে পরমাণু বোমার তেজস্ক্রিয়তার শিকার হয়ে পরবর্তী সপ্তাহ, মাস এবং বছরগুলোতে আরও বহু মানুষ মারা গিয়েছিল।

লাখ লাখ শিশু অনাথ হয়েছিল সেদিন
কেন এ নারকীয় হত্যা লীলা? ৭৬ বছর আগে এ রকম একটা দিনে পরমাণু বোমায় কেঁপে উঠেছিল জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিক, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্র–ম্যান এর আত্মসমর্পণ এর আহ্বানে জাপান সাড়া না দেওয়ায়, তার নির্দেশে চালানো হলো এ হত্যা লীলা। উদ্দেশ্য জাপান কে জব্দ করা, আর দ্রুত যুদ্ধ শেষ করা। এই বোমা হামলার পর এশিয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আকস্মিক পরিসমাপ্তি ঘটে। ১৪ই আগস্ট জাপান নিঃশর্তভাবে মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।